
এনজিওর নামে গ্রাহকের ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, এনসিপি নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন
হাইমচর (চাঁদপুর) প্রতিনিধিঃ
চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায় ‘রীম টাচ্ কোম্পানি লিমিটেড’ নামক একটি এনজিওর বিরুদ্ধে প্রায় ১০ হাজার গ্রাহকের ২০ কোটি টাকা আত্মসাতের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও এনসিপির চাঁদপুর জেলার প্রধান সমন্বয়ক মাহবুব আলম। বুধবার হাইমচর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা এই চাঞ্চল্যকর অভিযোগ তুলে ধরেন।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রীম টাচ্ কোম্পানি বিগত পাঁচ-ছয় বছর ধরে লোভনীয় মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। কিন্তু সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে এবং টাকা ফেরত না দিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।
হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনের চা দোকানদার দেলোয়ার হোসেন হাওলাদার জানান, তার ৭ লক্ষ টাকা আটকা পড়েছে।
আলগী বাজারের ব্যবসায়ীদের প্রায় দেড় কোটি টাকা এবং উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কয়েক কোটি টাকা এই প্রতিষ্ঠানে আটকা পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একজন খাবার হোটেলের স্টাফ দুঃখ করে বলেন, তিল তিল করে জমানো তার ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা কোম্পানিতে রেখেছিলেন, যা এখন আর ফেরত পাচ্ছেন না। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য টাকার প্রয়োজন হলেও তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আলগী বাজারের হোটেল রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী মনির হোসেন অভিযোগ করেন, দুই বছরে ২ লক্ষ ২২ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন। মেয়াদ শেষে টাকা চাইতে গেলে ছয় মাসের মধ্যে দেওয়ার কথা বলা হলেও আর পাননি।
আলগী বাজারের কনফেকশনারী ব্যবসায়ী আব্দুল হান্নান জানান, দৈনিক সঞ্চয় করে তার ৫ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন, যা কোম্পানি উধাও হওয়ার পর ফেরত পাননি।
ফুটপাতের ফলের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর জানান, তার একমাত্র সঞ্চয় ৫৯,০০০ টাকা এই কোম্পানিতে রেখেছিলেন, যা এখন পাচ্ছেন না।
স্থানীয় অ্যাডভোকেট আবুল কালাম জানান, তার বোন জামাইয়ের ৬৬,০০০ টাকা কোম্পানিতে আটকা পড়েছে। তার বোন জামাই বর্তমানে ক্যান্সার আক্রান্ত, অথচ মাহবুব আলম তার সঙ্গে দেখা করেও কোনো সমাধান দেননি।
ব্যবসায়ী বাবুল শাহ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাহবুব সাহেব তাদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে চাঁদপুরে বসে আছেন এবং মোবাইল ফোনও ধরছেন না।
আব্দুর রশিদ শেখ জানান, ডিপিএস-এর নামে তার নিজের ৩ লক্ষ টাকা এবং তার মাধ্যমে আরও ৭ লক্ষ টাকা, মোট ১০ লক্ষ টাকা এই কোম্পানিতে জমা রেখেছিলেন।
মজিদ মুন্সী, যিনি ১৮ বছর আগে রীম টাচ কোম্পানিতে কাজ করতেন, জানান তার মাধ্যমে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা জমা রাখেন গ্রাহকরা। তিনি অভিযোগ করেন, মাহবুব আলম এই টাকা দিয়ে চাঁদপুরে পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স, কয়েকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং হাইমচরে ৫-৬ শত অটো বিক্রি করে পালিয়েছেন। তিনি আরও জানান, হাইমচর উপজেলায় তাদের কোম্পানিতে প্রায় ৪০০ লোক কাজ করেছেন এবং ১০ হাজারেরও বেশি গ্রাহক রয়েছেন, যাদের প্রায় ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ‘রীম টাচ্ কোম্পানি লিমিটেড’-এর চেয়ারম্যান মাহবুব আলম, উপজেলা ইনচার্জ আব্দুল হান্নান, জেলা ইনচার্জ জাফর আহমেদ, এবং ফিল্ড কর্মী বিল্লাল হোসেন মিলে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন। অভিযোগকারীদের দাবি, এই চারজনই বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন।
আলগী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম কোতোয়াল জানান, রীম টাচ লিমিটেডের এমডি মাহবুবুর রহমান, যিনি পূর্বে জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানে জেলার এনসিপির সমন্বয়ক, তিনি আলগী বাজার রীম টাচ কোম্পানি দিয়ে গ্রাহকদের মোটা অঙ্কের লাভের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তিনি আরও বলেন, মাহবুব আলম এই টাকা দিয়ে চাঁদপুরে রীম টাচ্ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আল আমিন ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, তারা হাইমচর থানা ও সেনা ক্যাম্পে অভিযোগ করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সুরাহা পাননি। তারা প্রশাসনের কাছে দ্রুত অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এনে তাদের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন। গ্রাহকদের প্রশ্ন, কোটি টাকা আত্মসাৎকারী মাহবুব কিভাবে এনসিপির জেলার প্রধান সমন্বয়কারী হলেন। এ বিষয়ে তারা এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় হাইমচরের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তারা দ্রুত বিচার এবং তাদের হারানো অর্থ ফেরত পাওয়ার আশায় প্রশাসনের দিকে চেয়ে আছেন।
এ সময় সংবাদ সম্মেলনে হাইমচর প্রেসক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ ফারুকুল ইসলাম এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সাহেদ হোসেন দিপু পাটোয়ারীর পরিচালনায় প্রেসক্লাবের সদস্যরা ও স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।